ছাত্রলীগ: আত্মউপলব্ধি নয়, অস্বীকারই সমাধান!

0
511

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, যে কোনো বিবেচনাতেই খুব তৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর গঠন করা একটি ছাত্র সংগঠন প্রায় ৬ যুগ অতিক্রম করল। যে ছাত্র সংগঠনটি বাঙালি জাতির প্রতিটি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্র সমাজ। সেই আন্দোলনেরও অন্যতম শক্তি ছিল ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের পেছনের ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। পেছনের ইতিহাস আর গত আট দশ বছরের ছাত্রলীগের যে ইমেজ, তা অতীতের প্রায় পুরোপুরি বিপরীত। এমন একটি অবস্থায় পালিত হলো ছাত্রীলগের ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই প্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। পরিবর্তন ডটকমে ছাপা ছাত্রলীগ নিয়ে গোলাম মোর্তোজার মতামতটি আজ সারাবেলা ডটকমের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল।

০১.
একটি টেলিভিশন টকশোতে ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে হয়েছিল। যদিও আগে থেকে জানতাম যে, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত থাকবেন। হয়তো তাদের পাওয়া যায়নি বা অন্য কোনো কারণে বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদককে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা, বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে, সেটা খুবই প্রাসঙ্গিক। জ্যামের কারণে রাত বারোটার টকশোতেও ১৫ মিনিট পরে গিয়ে পৌঁছলাম।

আলোচনায় ছাত্রলীগের অতীত গৌরব-অবদানের কথা বললাম। এবং সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিলাম যে, আজ আর বর্তমান সময়ের ছাত্রলীগের কর্মকান্ড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। শুধু বললাম ৭০ বছরের ছাত্রলীগের এখন আত্মোপলব্ধি করা দরকার যে, এখন তাদের ইমেজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে কেন। ছাত্রলীগ যারা পরিচালনা করছেন, তাদের উপলব্ধিতে বিষয়টি আসা দরকার যে, কেন পাবলিক পারসেপশন এমন হয়ে গেল।

এত ঐতিহ্যবাহী একটি ছাত্র সংগঠন সম্পর্কে এত নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়ে যাওয়া কোনো বিবেচনাতেই ভালো ব্যাপার নয়। ছাত্র রাজনীতির স্বার্থে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের ভেতরে আত্মসমালোচনার মানসিকতা তৈরি হওয়া দরকার। তা যদি হয়, তবে ইমেজ পুনরুদ্ধার অসম্ভব নয়। আত্মোপলব্ধি বা আত্মসমালোচনার অবস্থানে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব যাবে কিনা, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

০২.
ছাত্রলীগ সভাপতি তার বক্তব্যে পাবলিক পারসেপশন আর মিডিয়া পারসেপশনের ব্যাখ্যা দিলেন। তার ব্যাখ্যা, ছাত্রলীগ সম্পর্কে অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে গণমাধ্যম। ছাত্রলীগ যা করে না, তা লেখে। ছাত্রলীগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের পারসেপশন সবসময় ভালো ছিল। এখন আরও ভালো। মিডিয়া খারাপ পারসেপশন তৈরি করতে চায়।পাবলিক পারসেপশন খারাপ, এটা ঠিক নয়। পত্রিকা তার কাটতি বাড়ানোর জন্যে, ছাত্রলীগ সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে।

ছাত্রলীগ যে ভালো কাজ করে, মিডিয়া তা লেখে না। শুধু অসত্য খারাপ খবর প্রকাশ করে। ভালো কাজ বলতে তিনি, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় রক্তদান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহায়তা, বন্যার্তদের মাঝে সহায়তাসহ আরও কিছু বিষয়ের উদাহরণ দিলেন। আমার বক্তব্য উল্লেখ করে বারবার বললেন, ঢালাওভাবে ছাত্রলীগের যে সমালোচনা করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।

০৩.
কোনো ঘটনার উল্লেখ না করে ‘ইমেজ’ নিয়ে কথা বলেছিলাম। সেটাকে ‘ঢালাও সমালোচনা’ বললেন ছাত্রলীগ সভাপতি। এরপর বিস্তারিত নয়, অল্প কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম। ছাত্রলীগের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নেতাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নেতাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। ঠিকাদারী নিয়ে দুই গ্রুপ গুলি বিনিময় করে। নেতাকর্মী নিহত-আহত হয়।

কলেজের অধ্যাপককে লাথি দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে। উদাহরণ হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার ঘটনা বললাম।

জবাবে ছাত্রলীগ সভাপতি বললেন, এসব ঢালাও সমালোচনা। সত্য নয়। বাংলাদেশের কোথাও ছাত্রলীগ ঠিকাদারী নিয়ে মারামারি করে না। সব ডিজিটাল হয়ে গেছে। ঠিকাদারী নিয়ে মারামারির সুযোগই নেই। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের যে বিষয়গুলো বলা হলো, তা ঠিক নয়। ট্রেন থেকে ফেলে দেয়ার যে কথা বলা হলো, তা সত্যি না।

ছাত্রলীগের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নেতাকে ফেলে দিয়েছে, মিডিয়া এ কথা লিখেছে। কিন্তু তারা আসলে ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপ ছিল না। মিডিয়া না জেনেই এ কথা লিখেছে। তিনি প্রায় প্রতিটি ঘটনারই এমন ব্যাখ্যা দিলেন। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘর্ষ, নিহত-আহতের সব ঘটনা অস্বীকার করলেন। বললেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটে না। মিডিয়া অসত্য সংবাদ প্রচার করে।

০৪.
আরেকটি টেলিভিশনের টকশোতে ছাত্রলীগ সভাপতির বক্তব্য শুনছিলাম। প্রশ্নফাঁস প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ নিয়ে দর্শকের প্রশ্ন এসেছিল। বিগত কয়েক মাসে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন হল পর্যায়ের নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

এ কারণেই দর্শকের প্রশ্ন। জবাবে ছাত্রলীগ সভাপতি বললেন, ‘প্রথমেই যে কথাটা আপনি বললেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস। যেখানে বাংলাদেশে কোথাও কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনাই ঘটে না, সেখানে কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ জড়িত বলেন?… বর্তমান সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো সুযোগ নেই।’

০৫.
প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতির এই বক্তব্যের পরে, যুক্তি বা তথ্য দিয়ে কথা বলার চেয়ে বাকামি বা বুদ্ধিহীন কাজ আর কিছু থাকতে পারে বলে মনে হয় না।

ইমেজ সংকট বিষয়ে ছাত্রলীগের উপলব্ধি বা আত্মসমালোচনার আলোচনাটা যে, একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

একজন ক্ষুদ্র সংবাদকর্মী হিসেবে নিজের কিছু বিষয়ে আত্মোপলব্ধি হওয়ার দরকার কিনা ভাবছি। যদি এভাবে ভেবে নেয়া যায় তবে সম্ভবত আর কোনো সমস্যা থাকে না।

ক. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা মানিক কর্তৃক ধর্ষণের সেঞ্চুরির কোনো ঘটনা ঘটেনি।

খ. গত নয় বছরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের ৬০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী নিহত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। গণমাধ্যম সংঘর্ষ ও নিহত হওয়ার যেসব সংবাদ প্রকাশ করেছে তা সত্য নয়।

গ. ঠিকাদারী নিয়ে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। গণমাধ্যম কাল্পনিক সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ঘ. দেশে কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাই ঘটছে না। গণমাধ্যম অসত্য বা কাল্পনিক সংবাদ পরিবেশন করছে।

ঙ. শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ড. ইয়াসমিন হক যা বলেছিলেন, তা অসত্য ছিল।

চ. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগ হামলা করেছিল বলে গণমাধ্যম যে সংবাদ প্রকাশ করেছিল, তা সত্য ছিল না।

ছ. বিএল কলেজের অধ্যক্ষকে লাথি দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিচ্ছে ছাত্রলীগ, সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ভেবে নিতে হবে, ঘটনা এবং ছবি দুটোই অসত্য ছিল।

জ. ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সংগঠনের নেতাকর্মীরা যে ‘আর্থিক অভিযোগ’ এনেছেন সেই সংবাদও গণমাধ্যম প্রকাশ করে ঠিক কাজ করেনি। গণমাধ্যমের ভেবে নেয়া দরকার ছিল, ঘটনা অসত্য।

ঝ. প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর পরের দিনের পত্রিকায় অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা সত্য নয়।

ঞ. ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কুমিল্লা মেডিকেল বন্ধ ঘোষণা, গণমাধ্যমের এই সংবাদ সঠিক নয়।

০৬.
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সত্যকে, সবচেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করতে পারাটাই- সবচেয়ে বড় সত্য। অস্বীকার করে অন্যায়কে জাস্টিফাই করলেই, সকল অসত্য সত্যে পরিণত হবে- অন্যায় ন্যায়ে পরিণত হবে।

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক। 
s.mortoza@gmail. com

 

আজ সারাবেলা/জ্যাকি/কলাম